Homeজেলা সংবাদএকজন শিক্ষার্থী একটি সমন্বিত কৃষি খামার

একজন শিক্ষার্থী একটি সমন্বিত কৃষি খামার


“একজন শিক্ষার্থী একটি খামার” হলো একটি স্বপ্ন যা দেশের জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরে বসবাসরত সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় কৃষিকাজকে (খাদ্যশস্য, পশু-পাখিপালন, মৎসচাষ ও বনায়ন) জনপ্রিয় করা। আর এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে প্রধানত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে। মূলতঃ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমেই যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী তাদের নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় বাগান তৈরি করবে। দ্বিতীয়ত যে সব পরিবারে কোন শক্ষার্থী নেই সেই সব পরিবারের কাছে সরকারের এই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হবে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের নিবিড় তত্বাবধানে। তৃতীয়ত এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে স্থানীয় এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের জনগোষ্ঠির সাহায্যও নিতে পারে।
এই প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এতে সরকারের কাছে বাজেট প্রণয়নের বিষয়ে কোন প্রস্তাবনার প্রয়োজন নেই। দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থার স্থানীয় উৎসই এখানে কাজে লাগানো যেতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশ ও নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের নিবিড় তত্বাবধানে ঘোষিত বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতে পারে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে সকল শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি যেমন, লালশাক, পুঁইশাক, পালংশাক, কলমিশাক, কচুশাক, মুলাশাক, গিমাশাক, ডাটাশাক, ধনেপাতা, বেগুন, মরিচ, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, চিচিঙ্গা, করোলা, শসা ইত্যাদি জন্মাতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এর বাইরে চারা রোপন ও ফসল উৎপাদনের মধ্যবর্তী সময়ে তারা ক্ষুদ্র পরিসরে হাস-মুরগী, গরু-ছাগল এমনকি মাছ চাষও করতে পারে। পাশাপাশি পরিবারগুলো হার্টিকালচার, বনপালন এবং ঔষধি গাছ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ যেমন, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, তাল, বেল, কামরাঙ্গা, সজিনা, নিম, বাতাবি লেবু, কাঠাল, আম এবং বিভিন্ন ধরনের কাঠ উৎপাদনকারী গাছ তাদের আঙ্গিনায় বা বাড়ির পাশে রোপন করবে।
এই কর্মসূচী গ্রহনের মধ্যদিয়ে শহর ও গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলোর বড় একটি অংশের আর্থিক ও পুষ্টি মেটানো সম্ভব। আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি এই কর্মসূচী গ্রহণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দৃষ্টিকোন থেকে যথেষ্ট লাভজনক বলে প্রমানিত করা সম্ভব । এই কর্মসূচীর সাথে জড়িতরা খুবই অল্প খরচে (চারা এবং অল্প পরিমান সার) তাজা, স্বাস্থ্যকর ও ভেজাল মুক্ত খাদ্য গ্রহনে সক্ষম হবে। তাদের লাগানো বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ শুধু ভেজালমুক্ত ও সুস্বাদু ফলই দেবে না বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকেও রক্ষা করবে। প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা তাদের বন্ধু-বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে উৎপাদিত শাকসবজি বিনিয়ম করে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতে পারবে। উৎপাদিত পণ্যের কিছু অংশ বাজারে বিক্রির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা উপকরণ ক্রয়সহ অন্যান্য সুবিধা নিতে পারবে। অতিরিক্ত উৎপাদিত পন্য বাজারে বিক্রির মাধ্যমে সাধারণ জনসাধারণের মাঝে ভেজালমুক্ত খাদ্য সরবরাহে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে। প্রকল্পে অংশগ্রহনকারীরা ডিম, মাছ, মাংস, ফলমূল ও শাক সবজি খাবার তালিকায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, খনিজ ও ভিটামিনের অভাব পূরণ করতে পারে। তাদের লাগানো বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ শুধু ভেজালমুক্ত ও সুস্বাদু ফলই দেবে না বরং ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকেও আমাদের আবাসভূমি সুরক্ষিত হবে। এ কর্মসূচী বাগান পরিচর্যা, পশুপালন, মাছচাষ ইত্যাদিতে অংশগ্রহনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মননমানসিকতা সজিব হবে এবং তারা একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। এছাড়াও এ ধরনের কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনের নেতিবাচক ব্যবহার থেকে দূরে রাখা সম্ভব।
শিক্ষার্থীরা স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি, বেসরকারি ও রাজনৈতিক সংগঠনের সহায়তায় খাস জমি, রাস্তা ও রেলপথের পাশে, চরের জমি, বেড়িবাঁধ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের বৃক্ষ রোপনের জন্য ব্যবহার করতে পারে। স্থানীয় বন বিভাগের সহায়তায় বিনা মূল্যে গাছের চাড়া বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দ্বারা বনায়ন করা সম্ভব। নগর এবং শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা তাদের বাড়ির কাছাকাছি অব্যবহৃত খালি জমি ব্যবহার করতে পারবে। জমি না পেলে তাদের বাড়ির ছাদ ব্যবহার করে সবজি বা ছোট ছোট ফলের গাছ রোপন করে বাগান তৈরি করতে পারবে। তারা তাদের বাড়ির বারান্দায় বিভিন্ন অব্যবহৃত পাত্র যেমন, ব্যবহৃত তেলের কন্টেইনারে বিভিন্ন ধরনের লতা বা লতা জাতীয় গাছ যেমন, করোলা, শসা, মরিচসহ বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি উৎপাদন করে নিজের পরিবারের সুস্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে পারবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত খালি জমিতে শিক্ষার্থীদের দ্বারা বিভিন্ন মৌসুমি এবং অঞ্চল উপযোগী শাকসবজি উৎপাদন করানো যেতে পারে। প্রস্তাবিত কর্মসূচীর মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ‘ভার্মিকম্পোস্ট প্রযুক্তি’ এবং জৈব সারসহ কৃষি ক্ষেত্রে নতুন নতুন গবেষনার মাধ্যমে উৎপাদিত প্রযুক্তির সাথে নিজেদের পরিচিত করে তুলবে। এই প্রকল্পে শিক্ষার্থীরা সব কিছুই উৎপাদন করবে “জৈবিক কৃষি পদ্ধতি” ব্যবহারের মাধ্যমে যা “সবুজ কৃষি” নামে পরিচিত যেখানে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে বিভিন্ন ধরনের শাক-সব্জি উৎপাদন করা হয়। সমবায় বাজার ব্যবস্থা অথবা ই-মার্কেটিং-এর মাধ্যমে ভেজাল ও রাসায়নিক সারমুক্ত এই সব খাদ্য শহরের বাজারে সরবরাহের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি যেখানে কৃষি, শিক্ষা, প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ, মৎস সম্পদ, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবগণের পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ডি.এ.ই এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংস্থার প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন। কৃষি মন্ত্রনালয়ের উদ্দ্যোগে বিভিন্ন গবেষণা ও সহায়ক সংস্থার সহায়তায় একটি “ম্যানুয়্যাল” প্রস্তুত করা হবে। উল্লিখিত মন্ত্রনালয় এবং বিভাগগুলো সরাসরি যুক্ত থাকবে কারণ তাদের ইউনিয়ন ও জেলা পর্যায়ের ব্লক সুপারভাইজার ও কর্মী আছে। প্রাথমিকভাবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উপজেলার কৃষি বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত সকল কর্মকর্তাদের নিয়ে শিক্ষকদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন করবেন। এরপর শিক্ষকগণ তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষন ও পরামর্শ প্রদানের পর তাদেরকে এ সংক্রান্ত “ম্যানুয়াল” প্রদান করবে। শিক্ষকেরা সারা বছরের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবে। শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, কৃষি গবেষনা সংস্থা, এনজিও, ইউটিউব, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন মিডিয়ার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে শুরুতে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহন করা যেতে পারে। প্রথমে আটটি বিভাগ থেকে কমপক্ষে ২০ টি মহিলা কলেজকে নির্বাচিত করে প্রকল্পটি সূচনা করা যেতে পারে। তারপর ধাপে ধাপে এটি সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। আমরা পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার কাশীনাথপুর মহিলা কলেজে এই ধারণাটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছি। শুরুতে কলেজের সমস্ত শিক্ষক তাদের নিজ নিজ বাড়িতে এই কৃষি কার্যক্রম শুরু করবে এবং তারা অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীকে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে “শিক্ষার্থী কৃষি”র এই ধারনাটি বাস্তবায়নে জড়িত হবে।
এই লিখাটি কেবলই একটি ধারনামাত্র। আমরা এই ধারনাকে একটি পূর্ণাংগ প্রস্তাবনা হিসেবে প্রস্তুতির জন্য সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়, শিক্ষাবিদ, কৃষিবিদ, গবেষক, পরিকল্পনাবিদ, নাগরিক সমিতি এবং অন্যান্য সংস্থা ও ব্যক্তি বর্গের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও মতামত চাইছি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments